আমাদের ভারতবর্ষের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে আছে প্রচুর মন্দির। এক একটি মন্দিরের মাহাত্ম্য এক এক রকম। আর সেই মাহাত্ম্য এর টানে মন্দির গুলোতে উপচে পরে ভক্তদের ভিড়। বিভিন্ন মনষ্কামনা পূরণে ভক্তগণ মন্দিরে আসেন। কিন্তু মধ্যপ্রদেশের খাজুরাহো মন্দির এই সমস্ত মন্দির গুলি থেকে আলাদা। এখানে কোন ভক্ত সমাগম হয় না। বরং খাজুরাহো মন্দির হলেও বাস্তবিক অর্থে সে একটি ভ্রমণ স্থান রূপে পরিচিত। দেশ বিদেশ থেকে বহু পর্যটক আসেন এই মন্দিরে।
খাজুরাহো "টেম্পল অফ লাভ" নামে পরিচিত। এটি মধ্য প্রদেশের একটি প্রান্তিক এলাকায় অবস্থিত । একটি মন্দির না বলে একে মন্দির সমষ্টি বলাই ভালো। তবে মন্দিরের দেওয়ালে তৈরি করা ভাস্কর্য গুলো র কারণে অনেক সময় সাধারণ মানুষ একে ভুল বোঝেন। এবং অপূর্ব সৃষ্টি কে অশ্লীল বলে ভাস্কর্যগুলো কে নষ্ট করে দেন। তবে কিঞ্চিৎ ইতিহাসের জ্ঞান থাকলে বোঝা যায় এই মন্দিরের ভাস্কর্যগুলো তৈরি হওয়ার আসল কারণ। 950 থেকে 1050 খ্রিস্টাব্দের মধ্যে চান্দলা রাজাদের রাজত্বকালে এই মন্দিরগুলি নির্মাণ করা হয়েছিল। রাজ অনুগ্রহে দক্ষ শিল্পীদের হাতে গড়ে উঠতে থাকলো এই মন্দির গাত্রে কঠিন পাথর কেটে একের পর এক ভাস্কর্য মূর্তি । যেগুলি র মধ্যে বেশিরভাগই দেব দেবীদের মিলনের চিত্র ফুটিয়ে তোলা । যৌনতা এবং মিলন মুহূর্তের বিভিন্ন ভাস্কর্য ছড়িয়ে রয়েছে খাজুরাহো মন্দিরের গায়ে। এই কারণে এই মন্দির টিকে অনেকে অশ্লীল বলে থাকেন। তবে প্রাচীন ভারতীয় সংস্কৃতি অনুযায়ী যৌনতা বা মিলনের বর্ননা কিন্তু অশ্লীল নয়। কারণ আমরা অনেক প্রাচীন সংস্কৃত কাব্য এবং পুরাণ কাহিনীতে এগুলোর উল্লেখ পাই। তাহলে যখন পুরনো ভারতীয় ঐতিহ্য অনুযায়ী মিলন দৃশ্য বর্ণনা করা কোন অশ্লীলতা নয়, আজকের আধুনিক মানব সমাজ কেন একে অশ্লীল বলে? খাজুরাহো দর্শনে এত লুকোচুরি কেন? আসলে মন্দির গাত্রে ভাস্কর্য ফুটিয়ে তোলা তখনকার সমাজের প্রাচুর্য ,উদারতা এবং বৈভবের পরিচয় ছিল। বিশিষ্ট ভারত বিশেষজ্ঞ উদয়ন ইনদুরকার এই ভাস্কর্য গুলির মধ্যে কোথাও নোংরা কিছু দেখেননি । অর্থাৎ হাজার বছর আগেও আমাদের মানসিকতা অনেক বেশি উন্নত ছিল। যৌনতা তাদের কাছে অত্যন্ত সাধারণ একটি ঘটনা ছিল।
মুসলিম শাসনের সময় এই মন্দিরগুলির অধিকাংশ ধ্বংসপ্রাপ্ত হয় এবং তারপর এ মন্দিরগুলি পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে থাকে। জানা যায় মামুদ গাজনী ও নাকি খাজুরাহো মন্দিরের ঐশ্বর্য এর কথা শুনে এখানে এসেছিলেন লুটপাট চালানোর জন্য।
তবে খাজুরাহো মন্দির কে এমন ভাস্কর্য দিয়ে মুড়ে রাখার কারণ কি? অবশ্যই কোন বিশেষ কারণে এমন ভাবে মন্দির থেকে নির্মাণ করা হয়েছিল। আজ আমরা জেনে নেব সেই কাহিনী যা খাজুরাহো দর্শন করতে গেলে গাইডের মুখ থেকে শোনা যায়। প্রচলিত কাহিনী অনুযায়ী বারাণসীতে হেতমবী নামে এক অপরূপ সুন্দরী বিধবা যুবতী বাস করত। একবার গ্রীষ্মকালে জোসনা আলোকিত রাতে তিনি সরোবরে স্নান করছিলেন। সেই সময় তার অপরূপ দৈহিক অবয়ব এবং রূপলাবণ্যে মুগ্ধ হয়ে পড়েন স্বয়ং চন্দ্র দেব। তিনি হেতমবী কে কামনা করেন।এরপর হেতমবী এবং চন্দ্র দেবের মিলন ঘটে। এর ফলস্বরূপ হেতমবী গর্ভবতী হয়ে পড়েন। এবং নিজের ভুল বুঝতে পেরে অত্যন্ত চিন্তায় পড়েন। সেই সময় চন্দ্রদেব তাঁকে আশীর্বাদ করেন এবং বলেন তার সন্তান হবে প্রথিতযশা, শক্তিশালী এবং খাজুরাহোর প্রথম রাজা। তারপর হেতমবী বারানসি ত্যাগ করে খেজুর বনে গিয়ে সন্তান প্রসব করেন। এবং সন্তানের নাম রাখেন চন্দ্র বর্মন। পিতার মতো চন্দ্র বর্মন অত্যন্ত সুপুরুষ এবং শক্তিশালী ছিলেন। জানা যায় পিতার আদেশে এই তিনি এই মন্দিরগুলি নির্মাণ করেন, এবং মন্দির গাত্রে এমন ভাস্কর্য মূর্তি তৈরি করেন। বলা হয় মন্দিরের ভাস্কর্য মূর্তিগুলি আসলে হেতমবী ও চন্দ্র দেবের প্রেম ও কামনার প্রতিচ্ছবি। চন্দ্রদেব ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন এই মন্দির নির্মাণ করা হলে এবং এমন ভাস্কর্য তৈরি হলে তবেই হেতমবী তার পাপ থেকে মুক্ত হবেন।
হেতমবী কে নিয়ে আরেকটি গল্প কথা প্রচলিত আছে। সেই কাহিনী অনুযায়ী হেতমবী ছিলেন কলিঞজর রাজ্যের রাজ ব্রাহ্মণ মনিরাম এর কন্যা। তিনি বাল্যবিধবা ছিলেন। একদিন ভুলবশত মনিরাম রাজাকে অমাবস্যার রাত কে পূর্ণিমার রাত বলে ব্যাখ্যা করে ন। হেতমবী পিতা র এই ভুল জানতে পেরে অত্যন্ত চিন্তিত হয়ে পড়েন, এবং চন্দ্র দেব এর কাছে প্রার্থনা করতে থাকেন। হেতমবী র রুপ-লাবণ্যে মুগ্ধ হয়ে চন্দ্র দেব সেই সময় হেতমবী র সঙ্গ কামনা করেন, এবং তারা মিলিত হন। ফলস্বরূপ হেতমবী গর্ভবতী হয়ে পড়েন। পিতার কারণে কন্যার এই অবস্থা হওয়াতে শোকে মুহ্যমান হয়ে পড়েন, এবং নিজেকে নিজে অভিশাপ দিয়ে পাথরের মূর্তিতে পরিণত হন। পরবর্তীকালে হেতমবী র বীর পুত্র চন্দ্র বর্মন চান্দেলা রাজবংশ প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি খাজুরাহো মন্দির গুলি কে নির্মাণ করেন। এ খাজুরাহো মন্দির গুলি বেশ কয়েকটি মন্দিরের সমষ্টি। এর মধ্যে রয়েছে জাভান মন্দির, মিলন মন্দির এবং আরো অনেক মন্দির। মন্দিরটির ভাস্কর্যগুলো বেশিরভাগই বেলে পাথর দিয়ে নির্মিত। এই মন্দির টিকে শিব, বিষ্ণু এবং জৈন ধর্মের দেবতাদের মন্দির হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা হয়। খাজুরাহো মন্দিরে বিভিন্ন মূর্তি-প্রতিকৃতি রয়েছে। যার মধ্যে মাত্র 10 শতাংশ যৌনতা নির্ভর।
অনেক ঐতিহাসিক এবং পুরাতাত্ত্বিক দের মতে এই মন্দির দেবতাদের বিনোদনের স্থান অর্থাৎ দেবতাদের মিলনকেন্দ্র। আবার অনেকে এই মন্দির টিকে তান্ত্রিকদের যৌন সাধনার কেন্দ্র বলেও গণ্য করে থাকে। আবার অনেকে মনে করেন হিন্দু ধর্ম তথা মানব জীবনে কাম একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আর সেই কারণেই মন্দির গাত্রে এই ভাস্কর্য গুলিকে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।
এই মন্দিরের যে সমস্ত এরোটিক মূর্তি ফুটিয়ে তোলা হয়েছে তার মধ্যে বেশির ভাগই পুরুষ নারীর মিলনের দৃশ্য, পশুর সঙ্গে মানুষের মিলনের দৃশ্য, নৃত্যরত নারী মূর্তি, উন্নত বক্ষ এবং হালকা মেদ যুক্ত পুরুষ মূর্তি, স্নানরতা বা ক্রীড়ারত নারী মূর্তি দেখা যায়। এই মুর্তিগুলোর মাধ্যমে রাজপুত দের বিভিন্ন কাহিনী, রাজপরিবারের বিবাহ কাহিনী যেমন ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। তেমনি সাধারণ মানুষ যেমন কৃষকদের কোন ঘটনা অথবা বাদক দল এর কাহিনী ও চিত্রিত হয়েছে। এছাড়া বাঘ, সিংহ, হাতি এবং বিভিন্ন পক্ষীর মূর্তি ও রয়েছে এই মন্দিরে।
এই ছিল আমাদের টেম্পল অফ লাভ অর্থাৎ খাজুরাহো মন্দির এর কাহিনী। মধ্যপ্রদেশ ভ্রমণ এ গেলে আপনার ভ্রমণ তালিকা অবশ্যই সংযুক্ত করবেন এই মন্দির কে।
No comments:
Post a Comment